তপন বসু, আঞ্চলিক প্রতিনিধি ॥ আলোচিত প্রতারক সাহেদ করিম একাই নয়; দেশের আনাচে কানাচে রয়েছে সাহেদের মতো আরও অসংখ্য প্রতারক। এমনই এক অবনণীয় প্রতারকের সন্ধান মিলেছে বরিশালের আগৈলঝাড়ায়। ওই প্রতারক কখনো নিজেকে প্রধান মন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব, কখনো প্রধান মন্ত্রীর পিএস-২’র বন্ধু পরিচয়, কখনো প্রভাবশালী মন্ত্রীর পিএস, এপিএস, মন্ত্রনালয়ের সচিব, ডিসি, এসপি পরিচয়সহ প্রভাবশালী মন্ত্রীদের নাম ভাঙ্গিয়ে নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা পরিচয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার অসহায় লোকজনের কাছ থেকে চাকুরী দেয়াসহ বিভিন্ন তদ্বিরের নামে সংঘবদ্ধভাবে প্রতারনার করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে। বরিশালের আগৈলঝাড়ার প্রতারক মিঠুন বিশ্বাসের নামে প্রতারনার ঘটনায় একাধিক মামলা ও প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর পিএস থানায় জিডি পর্যন্ত করেছেন। তার পরেও প্রশাসনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে ওই প্রতারক ও তার সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা। থানায় প্রতারনায় অভিযোগ দিলেও অজ্ঞাত কারনে হচ্ছে না মামলা রেকর্ড।
চাকুরী প্রতারিত অসংখ্য যুবক-যুবতীরা মিঠুনের কাছ থেকে তাদের টাকা ও শিক্ষার মুল সনদপত্র ফেরত না পেয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। প্রতারনার শিকার দেশের বিভিন্ন এলাকার ভুক্তভোগীরা মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ঠ উর্ধতন প্রশাসনের কাছে প্রতারক মিঠুন কুমার বিশ্বাসকে গ্রেফতার পূর্বক দৃষ্টান্ত মুলক বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
কে এই মিঠুন? বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা ইউনিয়নের আস্কর কালীবাড়ি গ্রামের মৃত যোগেশ বিশ্বাসের ছেলে মিঠুন বিশ্বাস (৫০)। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম তার। চার ভাই, এক বোনের মধ্যে মিঠুন সবার ছোট। মিঠুন বিয়ে করেন একই এলাকার সুভাষ বৈদ্যর মেয়ে বেবী বৈদ্যকে। শ্বশুর পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে ভারতের বাসিন্দা। অন্য ভাইয়েরা বাড়িতে সংসারী কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বোনের বিয়ে দেয়া হয়েছে। বিবাহিত জীবনে মিঠুন ও বেবী এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে ও মেয়ে ঢাকায় দু’টি বেসরকারী কলেজের শিক্ষার্থী। তবে মিঠুনের বিরুদ্ধে প্রতানার আশ্রয় নিয়ে একাধিক বিয়েরও অভিযোগ রয়েছে।
ভয়ংকর প্রতারক মিঠুন কুমার বিশ্বাস নিজেকে একেক সময়ে একেক জায়গায় ভুয়া পরিচয় দিয়ে কখনো প্রধান মন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব, কখনো প্রধান মন্ত্রীর পিএস-২’গাজী হাফিজুর রহমান লিকুর বন্ধু, কখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরীবিক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক মন্ত্রী আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ’র ২৬বছরের পিএস হিসেবে কর্মরত, কখনো গ্রেনেড হামলায় নিহত আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানের সাথে মারা যাওয়া সাবেক নারী সাংসদ বেবী বিশ্বাসের স্বামী ; তাই প্রধানমন্ত্রীর বিস্বস্ত ও আস্থা ভাজন, আবার কখনো ২৬তম বিএসিএস’এ ভর্তি এডিশনাল এসপি, জায়গা বিশেষ বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের সচিব, কখনো কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা ও বরিশাল জেলা সেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক, কখনো ঠিকাদারসহ ব্যবসায়ি হিসেবে জাহির করেন নিজেকে। তবে তার দেয়া সবগুলো পরিচয়ই ভুয়া। মিঠুনের প্রতারনার সাথে তার পরিবার সদস্যসহ রয়েছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। গ্রামবাসী ও স্থানীয়দের কাছে মিঠুন ‘ফটকে’ বা ‘ফটকা’ নামেই পরিচিত। মিঠুনের অভিনব ও ভয়ংকর প্রতারনা চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে তার উজিরপুর উপজেলায় বিয়ে দেয়া বোনের ছেলে বিপুল বৈদ্য ও মিঠুনের আস্কর গ্রামের তার বংশের কমল বিশ্বাস। তারা মিঠুনের হয়ে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন মন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) পরিচয়ে মিঠুনের হয়ে তার পক্ষে ফোনে কথা বলে মিঠুনের প্রতারনার সুযোগ তৈরী করে দিয়ে ভাগ নেয় হাতিয়ে নেয়ার অর্থের। এদের রয়েছে একাধিক সীম কার্ড। যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবৈধ কাজে ব্যবহার করে আসছে তারা। মিঠুনের প্রতারনার শিকার থেকে বাদ যায়নি তার নিজের বোনও।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরীবিক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক (মন্ত্রী) আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ’র ২৬বছরের পিএস’র ভুয়া পরিচয়ে মিঠুন বিশ্বাস সিলেটের মৌলভী বাজারের রাজনগর উপজেলার বিলবাড়ি গ্রামের বীনাময় দাসের ছেলে বিপ্র দাসসহ ওই এলাকার অনেকেই প্রতারিত হয়েছে মিঠুনের হাতে। প্রাতারিত বিপ্র দাস জানান, তিনি চাকুরী করেন সিলেট ভুমি অফিসে সার্ভেয়ার হিসেবে। তার চাকুরী স্থায়ী করনের জন্য ৩লাখ ৩৩হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় মিঠুন। একইভাবে প্রতারনার মাধমে বিপ্র’র মাসতুতো বোন পবিত্র কৈরীর মেয়ে শেফালী কৈরিকে সমাজসেবা অধিদফতরে কম্পিউটার অপারেটর ও প্রাইমারী স্কুলে চাকুরী দেয়ার নামে গত বছর নভেম্বর মাসে হাতিয়ে নেয় ৯লাখ ৭৬হাজার টাকা। হয়নি কোন চাকুরী। সব হারিয়ে একমাত্র শিশু কন্যাকে নিয়ে এখন মানুষের বাসায় ঝি’য়ের কাজ করছে শেফালী। সর্বস্ব খুইয়ে প্রতারক মিঠুনকে দেয়া টাকায় তাদের মতো অনেকেই প্রতি মাসে মোটা অংকের চড়া সুদ দিয়ে যাচ্ছেন সুদি ব্যবসায়িদের।
প্রতারিত চাকুরী প্রত্যাশী শেফালী খুঁজে বের করেন মন্ত্রী আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ’র একান্ত সচিব (পিএস) খায়রুল বশারকে। খায়রুল বশারের কাছে মন্ত্রীর ২৬বছর পিএস পরিচয়ে তাকে চাকুরী দেয়ার নামে মিঠুন বিশ্বাসের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার কৌশল খুলে বললে শেফালী জানতে পারেন যে, তিনি মিঠুনের চরম প্রতারনার শিকার হয়েছেন।
উল্লেখিত প্রতারক মিঠুন বিশ্বাস কখনও মন্ত্রী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ’র একান্ত সচিব বা অন্য কোন পদে কোন দিন কর্মরত ছিল না। প্রতারিত শেফালীকে আইনগত সহযোগীতা গ্রহন করার পরামর্শ দিয়ে মন্ত্রীর একান্ত সচিব খায়রুল বশার ভবিষ্যতের প্রয়োজনে প্রতারক মিঠুন বিশ্বাসের নামে চলতি বছর ২২সেপ্টেম্বর আগৈলঝাড়া থানায় সাধারণ ডায়েরী করেন, নং-৮৯৯। থানা অফিসার ইন চার্জ মো. আফজাল হোসেন থানা পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মাজহারুল ইসলামকে জিডি’র তদন্ত পূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন।
প্রতারনার দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিঠুন এক সময় ঢাকায় সিএন্ড এফ এর ব্যবসা করতেন। মন্দার কারনে ছাড়েন নিজের ব্যবসা। বর্তমানে স্থায়ী কোন পেশা না থাকলেও নিজেকে ‘বিশ্বাস এন্টার প্রাইজ’এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভিজিটিং কার্ড প্রদান করে আসছে। তবে বিশ্বাস এন্টার প্রাইজ কি ব্যবসার সাথে জড়িত তা জানা যায় নি। ব্যবসার ছদ্মাবরণে মিঠুন নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে অসহায় মানুষের চাকুরী, প্রমোশনসহ নানাবিধ প্রতারনার তদ্বির বানিজ্যে। চলেন মাস ওয়ারি ভাড়া করা বিভিন্ন নামি দামি ব্রান্ডের গাড়িতে।
মিঠুনের ভাড়া করা গাড়ির চালক যশোরের চৌগাছা উপজেলা সদরের মো. আব্দুল খালেকের ছেলে মো. আসাদ জানান, মিরপুর রেন্ট এ কার থেকে তার টয়োটা করোলা গাড়ি ভাড়া করেছিলেন বরিশালের মিঠুন। বডি ভাড়া ২১শ টাকা ও দৈনিক খাবার বাবদ ২শ টাকা এবং গ্যাস বিল ছিল মালিকের মধ্যে। একমাস মিঠুনের ভাড়ায় খাটলেও তিনি ঠিক মতো টাকা দিতেন না। গত বছর ডিউটি করে মিঠুনের কাছে তার পাওনা ১৮হাজার টাকা বহু কস্টে উসুল করেছেন তিনি। এখন আর মিঠুনের ভাড়ার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না বলেও জানান তিনি।
ড্রাইভার আসাদ জানান, শেফালী নামের একজন মহিলাকে চাকুরীর জন্য টাকা নিয়েছেন মিঠুন। কি চাকুরী আর কতো টাকা তা তিনি জানাতে না পারলেও ওই মহিলা তার (আসাদের) ব্যবহৃত বিকাশ নম্বরেও মিঠুনের জন্য টাকা পাঠাতেন। একদিন তার গাড়িতে করে শেফালী ও আরও দুজন চাকুরী প্রার্থী পুরুষকে মিঠুনের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তার গাড়িতে থাকতো মিঠুনের অনেক সীল, মিঠুন সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, সে নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে কার্ড বিলি করতেন। মিঠুনকে লোক হিসেবে তেমন সুবিধাজনক না উল্লেখ করে ড্রাইভার হিসেবে ডিউটি করাই ছিল তার কাজ বলে জানান তিনি।
প্রতারক মিঠুন দেশের বিভিন্ন এলাকায় আত্মীয়তার সূত্র ধরেও গড়ে তুলেছে তার প্রতারনা চক্রের শক্তিশালী সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক। তার প্রতারক চক্রের সংঘবদ্ধ এক সদস্য বরিশালের উজিরপুর উপজেলার কালবিলা, হারতা গ্রামের গুরুবর হালদারের ছেলে গোলক হালদার। গোলক সম্পর্কে মিঠুনের ভাগ্নির মেয়ে জামাতা। সেই সম্পর্কে মিঠুনের নাত জামাই হয়।
¬সূত্রে জানা গেছে, প্রতারক নাত জামাই গোলক বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে অফিস সহায়ক পদে নিজের চাকুরীর জন্য মিঠুন বিশ্বাসকে লোক দেখানোর জন্য ২লাখ টাকা প্রদান করে। চক্রের সদস্য গোলক মিঠুনকে কৌশলে নিজের চাকুরীর জন্য টাকা দিয়ে তার পরিচিতদের জানিয়ে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন ও বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে আরও চাকুরীর প্রলোভনে উৎসাহিত করে। গোলকের প্রলোভনে পরে চাকুরীর জন্য বরিশালের উজিরপুর উপজেলার কারফা গ্রামের প্রফুল্ল বেপারীর ছেলে পরিতোষ বেপারীর কাছ থেকে আড়াই লাখ টাকা, ওই গ্রামের বিমল মন্ডলের ছেলে তন্ময় মন্ডলের কাছ থেকে আড়াই লাখ, বরিশাল বিমানবন্দর থানা এলাকার সোলনা গ্রামের গনেশ চন্দ্র দাসের কাছ থেকে ঔষধ কোম্পানীতে চাকুরী দেয়ার কথা বলে ২০হাজার, গনেশের মামাতো ভাই একই থানার তিলক গ্রামের তন্ময় দাসের কাছ থেকে ৩ লাখ ৭৪হাজার টাকা গোলকের মাধ্যমে মিঠুন হাতিয়ে নেয়। প্রতারক ওই চক্রটি উল্লেখিত চাকুরী প্রার্থীদের কাছ থেকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য তাদের সকল শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র এমনকি জন্ম নিবন্ধনের মুল সনদপত্রও হাতিয়ে নেয়। মৌখিক পরীক্ষার জন্য মিঠুন তাদের বরিশাল ডেকে নিয়ে সেখান থেকে সটকে পরে। কোন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় তারা প্রতারকের খপ্পরে পরেছেন বলে নিশ্চিত হন।
এক পর্যায়ে মিঠুনের প্রতারনার শিকার তন্ময় দাস, পরিতোষ বেপারী, তন্ময় মন্ডল ও গনেশ দাস গোলককে তাদের টাকা ও সনদপত্র ফেরত দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করলে বাধ্য হয়ে ২০১৯ সালের ৪সেপ্টেম্বর গোলক হালদার প্রতারিত পাওনাদারদের নিয়ে মিঠুনের আগৈলঝাড়া আস্কর গ্রামের বাড়িতে যান। সেখানে মিঠুনের কাছ টাকা ও সনদপত্র ফেরত চাইলে মিঠু তাদের টাকা ও কাগজপত্র ফেরত দিবে না জানিয়ে গালমন্দ করে বিভিন্ন হুমকি ধামকী প্রদান করে। হুমকি ধামকী ও অর্থ প্রতারনায় ঘটনায় প্রতারক চক্রের সদস্য গোলক হালদার আগৈলঝাড়া থানায় মিঠুনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে বাধ্য হয়। ওই এজাহারে সকল পাওনাদারদের মোট ১০লাখ ৭৪হাজার টাকার পরিমান উল্লেখ করে তাদের স্বাক্ষী রাখতেও বাধ্য হয় গোলক। একই অভিযোগ উজিরপুর থানায়ও দায়ের করতে বাধ্য হয় গোলক। তবে কোন অদৃশ্য ইশারায়, অজ্ঞাত কারনে গোলকের ওই অভিযোগ মামলা হিসেবে রুজু করে নি কোন থানা।
এক পর্যায়ে বরিশাল বিমান বন্দর থানার সোলনা গ্রামের গনেশ দাস তার ও আত্মীয়র তিন লাখ টাকার দু’টি চেক প্রদান করে মিঠুন। ব্যাংক ওই দু’টি চেক ডিজ অনার করলে গনেশ দাস আদালতে চেক প্রতারনার অভিযোগে মিঠুনের বিরুদ্ধে ২টি পৃথক মমলা দায়ের করেন। যার নং- সিআর ৮০/২০ এবং ৮১/২০।
ওই মামলায় বিজ্ঞ আদালত মিঠুনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করলে কৌশলে চলতি সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখ মিঠুন আদালত থেকে জামিন নেয়।
তথ্যানুসন্ধানে বাগেরহাটে পানি উন্নয়ন বোর্ডে উপ-সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত হুমায়ুন কবির ফোনে জানান, বরিশালের এক লোকের মাধ্যমে মিঠুন বিশ্বাস একদিন তার কাছে গিয়ে মোংলায় তার ঠিকাদারী সাইড চলে জানিয়ে কিছু টাকা ধার চান। ওই ধারের টাকা ক’দিন পরে ফেরতও দেয় মিঠুন। এর কিছুদিন পরে আবারও মোটা অংকের টাকা ধার নিয়ে আর তাকে ফেরত দেয়নি মিঠুন; এখন ফোন দিলেও মিঠুন তার ফোন ধরে না বলে জানান তিনি।
মিঠুনের প্রতারনার শিকার হয়েছে সুনাগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার জাতুয়া গ্রামের দিলীপ কৈরীর স্ত্রী রেভা। রেভার কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে ৯লাখ ৮৯ হাজার টাকা।
ময়মনসিং জেলা সদরের ঋতিকা অভিযোগে বলেন, তাদের আত্মীয়র একটি জমি কিনতে গিয়ে পরিচয় হয় মিঠুনের সাথে। পরিচয়ের সূত্র ধরে একদিন মানিব্যাগ ভুলে ফেলে রাখার অযুহাতে টাকার অভাবে গাড়ির তেল কেনার জন্য এবং মিঠুনের মেয়ে মেডিকেলে পড়ছে উল্লেখ করে মিঠুনের ভাগ্নির জন্য টাকা পাঠাতে ১০ হাজার টাকা ধার নেয় মিঠুন।
ঋতিকার বোন শামসুন নাহারের মেয়ে গত বছর ময়মনসিং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি পরীক্ষায় ওয়েটিং লিষ্টে থাকায় তার ভর্তির ব্যবস্থা করে দেয়ার নামে ১লাখ ৫০হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় মিঠুন। মিঠুন নিজেকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভিজিটিং কার্ডও প্রদান করে তাদের। শামসুন নাহারের মেয়ের চট্টগ্রাম ডেন্টাল কলেজে ভর্তির সুযোগ হলেও মিঠুন ময়সনসিং সুযোগ করে দেয়ার কথা বলে চট্টগ্রাম ভর্তি হতে নিষেধ করায় একটি বছর ঝড়ে গেছে ওই শিক্ষার্থীর জীবন থেকে। ধার দেনা করে মিঠুনকে দেয়া লক্ষাধিক টাকার এখনো সুদ গুনছেন বলে জানান তারা।
মিঠুন কুমার বিশ্বাস সম্পর্কে তার ইউনিয়নের একাধিবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাবুল ভাট্টি বলেন, এলাকার মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশলে প্রতারনার মাধ্যমে টাকা নেয়ার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার পরিবার আওয়ামীলীগ সমর্থিত পরিবার এটা ঠিক, তবে এলাকায় মিঠুন কোন রাজনীতির সাথে জড়িত নয়। মিঠুনের একমাত্র বোনের মাধ্যমেও উজিরপুর এলাকার অনেক লোকের চাকুরী দেয়ার কথা বলে ১৭লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সে। তাকে দেয়া টাকা ফেরতের জন্য চাকুরী প্রার্থীরা তার বোনকে চাপ প্রয়োগ করায় তার বোন বাধ্য হয়ে ইউনিয়ন পরিষদে বিচার দিয়েছিলেন।
আগৈলঝাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবু সালেহ মো. লিটন বলেন, মিঠুন বিশ্বাস আওয়ামী লীগ বা অংগ সহযোগী সংগঠনের কেউ না। সে দীর্ঘ ১৫/২০ বছর যাবত বিভিন্নভাবে একটি চক্রকে নিয়ে সহজসরল লোকজনকে চাকুরী দেয়ার কথা বলে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। যদি কোথাও সে দলের কোন পরিচয় দেয়; তা সম্পূর্ন ভুয়া। ভুক্তভোগীদের পক্ষাবলম্বন করে তিনি এই মিঠুনের প্রতারণার তদন্ত সাপেক্ষ বিচার দাবি করেছেন। আগৈলঝাড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত মিঠুন বিশ্বাস সম্পর্কে বলেন, মিঠুন বিশ্বাস একজন প্রতারকের নাম। তার বিরুদ্ধে প্রতারনার বিস্তর অভিযোগ শুনেছেন তিনি। অনেকেই চাকুরীর জন্য তাকে টাকা দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, তার প্রতারণার বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে অনেক অভিযোগ রয়েছে।
থানা অফিসার ইন চার্জ মো. আফজাল হোসেন মিঠুন কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে মন্ত্রী মহোদায়ের একান্ত সচিব খায়রুল বশারের একটি জিডি করার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, তার বিরুদ্ধে আগৈলঝাড়া থানায় কোন মামলা নাই। দু’টি চেক প্রতারণা মামলায় তিনি জামিন নিয়ে রিকল দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ শোনা জাচ্ছে জানিয়ে ওসি মো. আফজাল আরও বলেন জিডি’র বিষয়ে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে পাশাপাশি ভুক্তভোগী শেফালীকে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ২০১৯ সালের ৪সেপ্টেম্বর গোলক হালদারের থানায় দায়ের করা কোন অভিযোগ তিনি পাননি বলে জানান।
অভিযোগের বিষয়ে মিঠুন কুমার বিশ্বাস ফোনে বলেন, কিছু ঘটনা সত্য, তবে সব ঘটনা সত্য নয়। তবে তার ভাতিজা সঞ্জয় বিশ্বাসসহ একটি মহল তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করাসহ অপপ্রচারে উস্কানী দিয়ে যাচ্ছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার বোনের কাছ থেকে চাকুরীর জন্য নেয়া টাকার মধ্যে ৩০হাজার টাকা ফেরত দিয়েছেন তিনি। শেফালী দাসের কাছ থেকে টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করে তিনি আরও বলেন, ওই মহিলা একজন হ্যাকার। সে তার আইডি হ্যাক করে অপপ্রচার চালানোসহ ছবি এডিটিং করে অপপ্রচার করছে। শেফালীর বিরুদ্ধে তিনি একাধিক জিডি করেছেন বললেও তার কপি চাইলে তিনি তা দেয়ার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত দিতে পারেন নি।
Leave a Reply